মেঘনা

আমি মেঘনা,
আমার জন্ম হয়েছিল এক মুসলিম পরিবারে, আমার মায়ের প্রথম সন্তান আমি,  আমার জন্মের পর শুনেছি ঘরের কেউ এতো খুশি ছিলো না আমায় নিয়ে শুধুমাত্র আমার মা ছাড়া।
ঘরের সবাই চেয়েছিলেন এক পুত্র সন্তান।
আর সেই ঘরে জন্ম হয় অভাগা আমার,
ছোটবেলা থেকেই অনেক অবহেলার স্বিকার হয়েছিলাম আমি কারণ ছিলাম আমি কন্যা সন্তান ,  মা ছাড়া সবার মনে একই আশা ছিল আমি যেন মরে যাই, কন্যা সন্তানকে খাইয়ে পরিয়ে লাভ কি আর, এক কথায় পরিবারের বোঝা ছিলাম।
ছোটবেলার এই অবহেলার কারণে অনেক অসুখের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমার, কিন্তু আমার মায়ের জন্য হয়তো বেচেঁ ছিলাম আমি।

স্কুলে পড়াশোনা করার ও অনেক ইচ্ছে ছিল আমার, কিন্তু পড়াশোনা বেশি আর হয়নি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে বাদ দিতে হয়েছিল । একা মা আর কতোটুকু করবে।

এখন শুধু একেরপর এক বিয়ের আলাপ নিয়ে আসা হচ্ছিল  আমার জন্য,  তখন ঠিক করে আমার ১৪ বছর ও পার হয়নি। আমার এই অবস্থা দেখে মা শুধু চোখের জল ফেলতো, কিছুতো আর করার তো ছিলো না মায়ের ও ।।

এইরকম কয়েকদিন যাবার পর আমি প্রেমে পরি আমার এক বান্ধবীর দাদার সাথে, যার নাম ছিল আসিফ।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছি বলে তার পর আসিফের অনেক সময় কাটাতাম, আমার মায়ের পর সে আসিফই ছিল যে আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতো আর ভালোবাসতো, ছোট থেকে এতো পাওয়া কষ্ট সব কিছুই ভুলে যেতাম যখন আসিফের সাথে থাকতাম ।

আস্তে আস্তে আসিফ আমাকে  পড়াশোনার সুযোগ করে দিল আসিফ বলতো, আমি তো কলেজ পর্যন্ত পরেছি, আমি যা জানি সব শিখিয়ে দেবো তোমাকে, তার পর কম্পিউটার ক্লাসেও ভর্তি করবো তোমাকে শহরে নিয়ে গিয়ে।
এই সব শুনে অনেক খুশি হতাম আমি,  আর ভাবতাম খোদা এতোটাও নিষ্ঠুর না যতোটা ছোটো থেকে ভেবে আসছি।

আর সব কথা আমি আমার মাকে গিয়ে বলতাম মা ও অনেক খুশি হতো এই সব কথা শুনে, আর বলতো যা এইবার খোদা তোর দিকে মুখ ফিরে তাকিয়েছে, তুই খুশি থাক মা  এটাই তো চাই আমি। ।

আসিফের সাথে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি, আমরা বিয়ে করবো আমাদের ও সংসার হবে, আসিফ সব সময় বলতো যে মেঘনা আমাদের বিয়ের পর আমাদের ও একটা মেয়ে হবে ওই মেয়েটা কে অনেক ভালো করে বড় করবো, অনেক ভালো স্কুলে পড়াশোনা করবো। 

আসিফের এই কথা শুনে আসিফের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধা আসতো, একদিকে আমার পরিবার, যারা কন্যা সন্তান কে বোঝা মনে করে আর একদিকে আসিফ।।

কিছু দিন যাওয়ার পর আসিফ আমাকে বলে তোমাকে বলেছিলাম যে কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি করবো সেটার সময় কিন্তু এসে গেছে তোমাকে সামনের সপ্তাহে নিয়ে যাবার কথা বলেছে তুমি তৈরি থাকবে কেমন।

আমি ওই অনেক খুশি ছিলাম যে কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হবো, তার পর আমিও ভালো চাকরি করবো,
সব কিছু মা কে গিয়ে বলি, যে শহরে যেতে হবে ভর্তির জন্য, মা ও রাজী হন।

তার এক সাপ্তাহ পর সময় আসে শহরে যাওয়ার, আসিফ বললো শহরে তোমার যেতে যাতে কোনো রকমের কষ্ট না হয় তাই এই ভেন গাড়িটা ভাড়া করে এনেছি,
আসিফ এতো ভাবে আমার জন্য তা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই আর আসিফকে জরিয়ে ধরে কাদতে থাকি আর আসিফ কে বলতে থাকি এতো ভালোবাসো আমাকে, সারা জীবন এইরকমই ভালোবাসো আমকে।

আসিফ তখন বলে এই পাগলী কাদে না এবার গাড়িতে ওঠো দেরি হয়ে যাবে যে।

তার পর গাড়ি করে শহরের দিকে রওনা দেই আমারা, আসিফ আমার জন্য গাড়িতে আগে থেকেই খাবার আর কোল্ড ড্রিংকস এনে রেখে ছিল, আসিফ আমাকে খাবার আর ড্রিংকস গুলো দে আমিও খাই,
খাবার কিছু সময় পর দেখি আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল আর শরীরটা নিস্তেজ হতে থাকলো,  শরীরটা এতো খারাপ লাগছিল যে আসিফ কে কিছু বলার আগেই আমি অজ্ঞান হয়ে পরি।

তার পর কি হলো কি না আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

প্রায় এদিন পর যখন একটু একটু জ্ঞান আসে তখন দেখলাম  আমি সেই গাড়িতেই আছি,
আপছা আপছা দেখছিলাম কোন এক জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলাম,

আর ঠিক তখন আসিফের কথা শুনি, আসিফ গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিল :- আর একদিনের ভিতরে পৌঁছে যাবো তো শিলিগুড়ি,  এই মালটাকে বিক্রি করে ভাড়ি  টাকা পাবো, বেচারি আমার প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বলে হাসতে থাকে।।

এই কথা শুনে আমি যেমন  আকাশ থেকে পরলাম , যাকে এতো ভালোবাসলাম সে আমার সাথে এইরকম করলো, ভালো করে জ্ঞান না আসায় না আমি ভালো করে কথা বলতে পারছিলাম না কিছু করতে পারছিলাম,  
তখন আসিফ দেখলো আমার আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরছে তা দেখে আসিফ একটা ইনজেকশন আমার হাতে পুস করে, তখন আবার অজ্ঞান হয়ে পরি আমি।

তার পর  আর কিছুই বলতে পারিনি আমি।

যখন আমার জ্ঞান ফিরলো দেখলাম আমি একটা অজানা ঘরে বন্দি  আর ঘরটা বাইরের দিক থেকে তালা দেওয়া।
কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে আমি কোথায়, কিছু সময় পর একজন মহিলা এসে আমার ঘরের তারাটি খোলে,  আর সাথে করে  কাপড় নিয়ে আসে আর বলে এই নে কাপড় গুলো পরেনে,
তখন ওই অজানা মহিলাটিকে জিগ্যেস করি আমি কোথায় আর আসিফ কোথায়?

মহিলাটি তখন বলে কে আসিফ, হা হা তোকে তো এইখানে বিক্রি করে চলে গেছে।  তুই এখন নরকে আছিস, তোর শরীর আজ থেকে তোর নয়,  তুই আজ থেকে আমাদের মতো এক রেন্ডি।

এই কথা শুনে আমি কাদতে থাকি, মনে মনে ভাবতে থাকি একি করলে খোদা।

মহিলাটি তখন বলে আর কেদে কি করবি এখন থেকে এটাই তোর জীবন, যা তৈরি হয়ে যা কাষ্টমার আসবে তোকে ভোগ করতে।।

আমি কাদতে থাকি আর ভাবতে থাকি একি হলো আমার সাথে।।

এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর নিজেকে বুঝাতে থাকলাম যে এটাই আমার জীবন।
আমি তখন শুধু  মৃত্যুর অপেক্ষা করতাম, ভাবতাম ছোট বেলাই মরে যেতাম তো আর এই দিন দেখতে হতো না আমার।।

আস্তে আস্তে এই জায়গার সবার সাথে মিলতে মিশতে থাকলাম ।

ঠিক তখন দেখা হয় আরও একটি মেয়ের সাথে নাম ছিল জরিনা, সেই মেয়েটি আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের ওকেও ভালোবাসার জ্বালে ফাসিয়ে এই জায়গায় বিক্রি করেছে। 
জরিনা বলে আরও একটি মেয়ে আছে ওদের গ্রামের সলিমা নামের।।
তার পর থেকে আমি ওদের সাথে রোজ কথা বলতাম ,  ওদের কে পেয়ে মনে আশা জেগে ছিল যে এই নরক থেকে আমরা বেরতে পারবো।

তার পর থেকে আমরা ৩ জন মিলে এই নরক থেকে কি ভাবে বেরোনো যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকি।

এখান থেকে বেরিয়ে কোনো রকম ভাবে কোনো পুলিশ থানায় গেলেই আমরা বাড়ি ফিরতে পারবো।

তো আমরা ভেবে রাখি আমাদের তো মাসে একবার শরীরের চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক তখনই আমরা পালাবো ,  আমরা ৩ জন থাকায়  আমরা অনেক সাহস পাচ্ছিলাম।

মাসের শেষে সময় আসে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আমরাও ভেবে রেখেছিলাম ওইদিন পালাবো,
ঠিক ওইদিনই যখন অন্যদের চেকআপ চলছিলো, ঠিক তখনই আমরা এক পা দু পা করে সেখান থেকে সরতে থাকি,  আমরা ৩ জন আলাদা আলাদা হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পরে এক জায়গায় জমা  হই।  আর তখনই আমরা ধরা পরে যাই সেই ছেলেটার কাছে যে আমাদের চেকআপের জন্য আনে।

কি করবো তখন বোঝতে পারছিলাম না, আমরা জানতাম আজকে না পালাতে পারলে আর কোনো দিন পারবো না।

এই কথা ভেবে আমারা ৩ জন ঝাপিয়ে পরি ওই ছেলেটির উপরে, ছেলেটি কে আঘাত করে কোনো রকম ভাবে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হই আমরা,
তার পর সামনে থাকা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সব কিছু বলার পর আমরা আমাদের নিজেদের ঘরে ফিরতে পারি।।

ঘরে ফিরে মায়ের কাছে আমি ভেঙে পরি মা একদম পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিল।
মায়ের থেকে পরে জানতে পেরেছিলাম ঘর থেকে আমাকে খোঁজার জন্য কোন চেষ্টাও করা হয়নি।।
তা শুনে মাকে জরিয়ে আমি কাদতে থাকি, আর বলতে থাকি মা গো খোদা কেন এতো নিষ্ঠুর।।

- ধীমান কুড়ি


Comments